বুধবার ০১ মে ২০২৪
Online Edition

নদী ভাঙনে বিদ্যালয় বিলীন হওয়ায় শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ছে চরাঞ্চলের শিশুরা

 

গাইবান্ধা থেকে জোবায়ের আলী : একনা দিন কাম না করলি সোগগুলাক না খায়আ থাকা নাগে’-এমন কথায় বলছিলেন, গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি উপজেলার মধ্য গলনা চরের পঞ্চম শ্রেণির প্রাক্তন শিক্ষার্থী মানিক মিয়া। পড়ালেখা করে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ইচ্ছে ছিলো তার। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নদীর কড়াল গ্রাসে যেমন তিন বার ভেঙ্গে গেছে স্কুল, তেমনি তিন বার ভিটে-মাটি হারিয়ে আজ নিঃস্ব তার পরিবার। এক সময় ওই চরে আধিপত্য করা মানিকের পরিবার র্বুমানে ব্যাঙ্কার চরে বসবাস করছে অন্যের জমিতে। আর গণ কয়েক বছরে তিন তিন বার নদীতে শুধু ঘরবাড়ি, আবাদী জমি, গৃহপালিত পশু-পাখি, স্কুল, ক্লিনিকই নয়, তার সাথে ভেসে গেছে শিশু মানিকের স্বপ্ন। আর এই গল্প একা মানিকের নয়, চরের এমন অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে, যারা পড়ালেখার ইচ্ছে থাকলেও দারিদ্র্যতার জন্য স্কুলে ফিরতে পারছে না। এমনই এক শিক্ষার্থী রতন। বাড়ি কুন্দেরপাড়া চরে। কয়েক বছর আগে নদীতে ভেসে গেছে ঘর-বাড়িসহ তাদের সর্বস্ব। কয়েক দিন পর বন্যার পানি নেমে গেছে ঠিকই, কিন্তু ভেঙ্গে যাওয়া কোনো কিছুই আর ফেরত আসে নি। অসুস্থ বাবা-মাকে রেখে পাড়ি জমিয়েছে সুদূর ঢাকায়। এখন একটা গ্যারেজে কাজ করছে সে। এক সময় ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছে পোষণ করা ছেলেটি শিশুশ্রমের শিকার হয়েছে। অথচ কারও কিছু করার নেই। প্রকৃতির কাছে সবাই যেনো জিম্মি। প্রতি বছরই নতুন বই-খাতা, কলম-পেন্সিল, পোশাকের সাথে নতুন স্বপ্ন বুনে গাইবান্ধা জেলার ১শ’ ৬৫টি চরের শিশুরা। কিন্তু প্রতি বারই তাদের উদ্যোমী চেতনাকে হতাশায় পরিণত করে বন্যা, নদী ভাঙন, খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, শৈত্যপ্রবাহসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ফলে দুর্যোগ শেষে অভাব-অনটন, দারিদ্র্যতার সাথে প্রনিনিয়ত লড়াই করতে করতে চাপা পড়ে তাদের শিক্ষার অধিকার। মনে লালন করা সুপ্ত ইচ্ছেকে চাপা দিয়ে রতনের মতো অনেক শিশুকে যুক্ত হয় খেতে-খামারে, গ্যারেজে কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ কোন কাজে। কেওবা জীবন-জীবিকার তাগিদে পাড়ি জমান ঢাকা শহরে। 

নদীভাঙনের কারণে শিশুদের ঝরে যাওয়ার সাথে সাথে এমনইভাবে বাড়ছে শিশুশ্রমও। যে বয়সে এসব শিশুর পড়ালেখা আর খেলাধুলা করার কথা, সে বয়সে নিজেদের সাজানো স্বপ্ন বিসর্জন দিচ্ছে তারা। আবার গাইবান্ধার যেসব চরাঞ্চলে ভাঙনের প্রকোপ নেই, সেখানে সমস্যা প্রতি বছরের বন্যা। আর বন্যায় নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য অন্যত্র ছুটে চলা পরিবারগুলো, পরে বাসায় ফিরলেও, বাড়ে অভাব-অনটন। ফলে তারা আরও নিজেদের সন্তানটিকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে আগ্রহ পোষণ করেন না। কাজে লাগিয়ে দেন বাড়তি দুই টাকা আয়ের আশায়। আবার অনেক শিশুর অভিযোগ, বন্যায় তাদের স্কুল অনেক দিন বন্ধ থাকে। এতে তাদের পড়ালেখা ব্যাহত হয়। অনেক সময় বন্যা নেমে যাওয়ার পরও পড়ালেখা হয় না। ফলে এক শ্রেণিতে দু’বার থাকতে হয়। যা তাদের ভালো লাগে না। বিপর্যয় কাটিয়ে এসব শিশুরা বিদ্যালয়মুখী হতে চাইলেও বন্যা বা নদী ভাঙনে বিলীন হওয়া বিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়ন কাজ দেরিতে হওয়ায় বিমুখ হয়ে পড়েন অনেকে। গাইবান্ধা সদর উপজেলা ও ফুলছড়ি উপজেলার বিভিন্ন চর ঘুরে দেখা যায়, নদী ভাঙনে বিদ্যালয় বিলীন হয়ে যাওয়ায় তাদের পাঠদান চলছে ত্রিপল টানিয়ে খোলা আকাশের নিচে। আবার, বিদ্যালয়গুলোতে দেখা মেলে না নির্দিষ্ট সময় অবধি শিক্ষকদের উপস্থিতি। ফুলছড়ির পুরাতন হেড কোয়ার্টার এলাকার নৌকার ঘাট থেকে ব্যাঙ্কার চরে পৌঁছাতে লাগে ১ ঘন্টা। এই ১ ঘন্টায় চর্তুদিকে শুধু নদীভাঙন ও বন্যা পরবর্তী দগদগা ঘা নজরে আসে।

 যমুনা নদীর মাঝে এক চিলতে এই চরটিতে সব হারিয়ে বাসা বেধেঁছে কয়েকশ’ পরিবার। ওই বাড়িগুলো ঘুরে দেখা যায়, মাত্র ৩০-৩৫ জন শিশু যাচ্ছে স্কুল-মাদরাসায়। যা খুবই হতাশাজনক। অভিভাবকদের সাথে কথা হলে ঘুরে ফিরে এক কথা, পেট চলে না, বাচ্চারা স্কুলে গিয়ে কি করবে। তার থেকে পরের হোটেলে কাজ করলেও দু’টাকা সংসারে আসবে। এ অবস্থায় বিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ কর্তৃপক্ষ কি করছে-এমন প্রশ্নের জবাবে গলনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোছা. খাদিজা খাতুন বলেন, নদীভাঙনের কারণে এখন পর্যন্ত ৪ বার বিদ্যালয়টি বিলীন হয়েছে। বার বার পুনঃনির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। আগে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ২ শতাধিক শিক্ষার্থী থাকলেও এখন এর সংখ্যা দাড়িয়েছে ৬০ জনে। আবার এই শিক্ষার্থীদেরও বাসায় গিয়ে গিয়ে নিয়ে আসতে হয়। বার বার অভিভাবকদের সচেতন করা হচ্ছে। তবে, এ পরিস্থিতিতে সর্বপ্রথম নদী ভাঙনরোধে স্থায়ীভাবে পুর্নবাসন করার তাগিদ দেন এই কর্মকর্তা। এ বিষয়ে আমাদের কথা হয়, ফুলছড়ি উপজেলার গজারিয়া ইউপি সদস্য মো. হাছান আলীর সাথে। 

এসময় নিজেই নিঃস্ব হয়ে বড় ভাইয়ের জায়গায় আবাসন গড়ে পরিবার নিয়ে বসবাসের কথা বলেন তিনি। এমতাবস্থায় চরাঞ্চলের পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের এগিয়ে নিতে অতিরিক্ত অনুদানসহ সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপ কামনা করেন এই জনপ্রতিনিধি। গাইবান্ধা জেলা শিক্ষা অফিসের তথ্যমতে, জেলার সদর উপজেলা, ফুলছড়ি, সুন্দরগঞ্জ ও সাঘাটা উপজেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ১শ’ ১৬ টি। অন্যদিকে, মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে ১২টি।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ